বিনা পরোয়ানায় পুলিশের গ্রেফতার ক্ষমতা ও করণীয়?


তারিখ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫ 


আমরা জানি, সাধারণত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে যদি গ্রেপ্তারের আদেশ না হয়, তবে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা যায় না। তবে পরোয়ানা ছাড়াও পুলিশ কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে। তবে এক্ষেত্রে যে অপরাধে ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হবে, তা অবশ্যই আমলযোগ্য হতে হবে। আমলযোগ্য অপরাধের ক্ষেত্রে ৫৪ ধারার অধীনে পুলিশ যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারে।


৫৪ ধারার অধীনে ৯ ধরনের অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারে পুলিশ। এই ৯ ধরনের অপরাধীকে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে পুলিশের আদালতের আদেশ লাগে না, অবশ্য এই ৯ ধরনের বাইরে খুব কমই অপরাধী আছে।


জেনে নেওয়া যাক যে ৯ ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিতে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যায়।


১. কেউ আমলযোগ্য অপরাধ করলে অথবা তাতে জড়িত থাকলে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। 


২. কারও কাছে ঘর ভাঙার সরঞ্জামাদি থাকলে সেই ব্যক্তিকে পুলিশ বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করতে পারবে। 


৩. সরকার কাউকে অপরাধী বলে ঘোষণা করলে অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রের ক্ষতিকারক কোনো কাজ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা যাবে। 


৪. মাদকদ্রব্য, অবৈধ অস্ত্র ও মুদ্রা বহন করলে। 


৫. আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজে বাধাদান বা আইনগত হেফাজত থেকে পলায়নকারী ব্যক্তি।


৬. সশস্ত্রবাহিনী থেকে পলায়নকারী ব্যক্তি।


৭. বিদেশে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি, যদি অপরাধটি বাংলাদেশে করলে অপরাধ হয়ে থাকে।


৮. কারামুক্তিপ্রাপ্ত আসামি যদি একই অপরাধ আবার করে।


৯. যে কোনো থানা থেকে আসামি গ্রেপ্তারের অনুরোধ পাওয়া গেলে।


এছাড়া ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৫৯ ধারায় বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে।


ভবঘুরে অথবা অভ্যাসগত অপরাধী অন্যকে ভীতি প্রদর্শন বা প্রদর্শনের চেষ্টা করলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫ ও ৫৬ ধারা অনুযায়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করতে পারবেন।


এছাড়া কোনো ব্যক্তি নাম, পরিচয় ও বাসস্থান গোপন করলে ৫৭ ধারা অনুযায়ী পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে। নাম, পরিচয় পেলে মুচলেকাসহ এই বিধানের অধীন গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ছেড়ে দেবেন। ছেড়ে দেওয়ার একটি প্রতিবেদন তিনি চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে দেবেন। ৪০ ঘণ্টার মধ্যে নাম পরিচয় না পাওয়া গেলে বা মুচলেকা প্রদানে ব্যর্থ হলে তাকে সঙ্গে সঙ্গে নিকটস্থ এখতিয়ার সম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অগ্রবর্তী করতে হবে।


ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থিত করার সময় গ্রেপ্তারের স্থান থেকে আদালতে যাওয়ার সময় বাদে সর্বোচ্চ ২৪ ঘণ্টা হবে।


আটকের পর ওই ব্যক্তির নাম, তারিখ ও সময় লেখা স্মারক প্রস্তুত করতে হবে। আটকের ১২ ঘণ্টার মধ্যে একজন নিকটাত্মীয় বা ক্ষেত্র বিশেষে বন্ধুকে জানাতে হবে। আটকের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাকে পরিচয় দিতে হবে এবং আটকের সময় যারা উপস্থিত থাকবেন, তাদের সামনে পরিচয়পত্র প্রদর্শন করতে হবে।


কোনো ব্যক্তিকে জখম অবস্থায় আটক করা হলে, তার কারণ উল্লেখ করতে হবে। একই সঙ্গে তাকে নিকটবর্তী হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দিতে হবে এবং চিকিৎসকের কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট নিতে হবে। আটককৃত ব্যক্তি কোনো আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করতে চাইলে অথবা নিকটাত্মীয়র সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাকে সেই সুযোগ দিতে হবে। 

★গ্রেপ্তার হলে যা যা করনীয়ঃ-

হঠাৎ গ্রেপ্তার করলে পুলিশের কাছে নিজের নাম, ঠিকানা ও পেশাসহ (যদি থাকে) পরিচয় তুলে ধরবেন। পেশাজীবী বা ছাত্র হলে পরিচয়পত্র দেখাবেন। পরিবারের সদস্য, স্বজন বা পরিচিত জনকে জানাবেন। এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য আগাম প্রস্তুতির অংশ হিসেবে পরিচিত আইনজীবীর ফোন নম্বর সঙ্গে রাখতে পারেন। গ্রেপ্তারের পর দ্রুত আইনজীবীকে বিষয়টি জানানোর চেষ্টা করতে হবে। অন্তত পরিবারের লোকজন, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুকে বিষয়টি দ্রুত জানাতে হবে। 


ঢাকায় গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নেওয়া হয়। আর যেকোনো থানা-পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলে সংশ্লিষ্ট থানায় নেওয়া হয়। 


গ্রেপ্তারের পর কাউকে লকআপে রাখার আগে তাঁর পরিধানের পোশাক ছাড়া অন্য জিনিসপত্র যেমন—কাগজপত্র, মোবাইল ফোন, টাকা-পয়সা ও ক্রেডিট/ডেবিট কার্ড ইত্যাদি থাকলে তাঁর কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা সেগুলোর একটি তালিকা তৈরি করে আটককৃত ব্যক্তির স্বাক্ষর নেন। এই স্বাক্ষর দেওয়ার সময় তালিকাটি অবশ্যই পড়ে নেওয়া উচিত। কারামুক্ত হওয়ার পর থানা থেকে ওই মালামাল তিনি আবার ফেরত পাবেন। 


আপনি যদি পুলিশ কর্মকর্তার কাছে কোনো জবানবন্দি বা স্বীকারোক্তি দেন তাহলে সেটির লিখিত রূপ ভালোভাবে পড়ে স্বাক্ষর করবেন। গ্রেপ্তারের পর আইনজীবী বা পরিবারের কাউকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি জানাতে না পারলে আদালতে হাজির করার পর ম্যাজিস্ট্রেটকে সরাসরি বিষয়টি জানানো উচিত। এতে আইনি সহায়তা পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। 


গ্রেপ্তারের পর কোনো পর্যায়ে নির্যাতনের শিকার হলে বা অসুস্থ হলে আদালতের মাধ্যমে বা নিজ উদ্যোগে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারবেন। পরীক্ষা করালে সেই প্রতিবেদনটি সংগ্রহে রাখবেন। পরীক্ষক চিকিৎসকের পরিচয় জেনে রাখা উচিত। কারণ তা পরে প্রয়োজন হতে পারে। পুরোনো কোনো মামলায় গ্রেপ্তার হলে দ্রুত ওই মামলার নম্বরসহ কাগজপত্র নিয়ে আদালতে গিয়ে জামিন শুনানির চেষ্টা করা যেতে পারে। নতুন কোনো মামলায় বা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার হলে একজন আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শক্রমে জামিন শুনানির চেষ্টা করতে পারেন। 


যদি আদালতের মাধ্যমে কারাগারে নেওয়া হয় তাহলে কারাগার থেকে মোবাইল ফোনে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। 


হঠাৎ গ্রেপ্তার হলে করণীয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেসের (ব্লাস্ট) ঢাকা ইউনিটের সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট মো. মশিউর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যদি কেউ হঠাৎ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তাহলে প্রথমেই তাঁকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিত জনকে জানাতে হবে। পুলিশের উচিত এই সুযোগটি করে দেওয়া। আর গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির সঙ্গে যেসব মালামাল থাকবে তা পুলিশ একটি তালিকা করবে। পরে সেই তালিকা গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে পড়ে শোনাতে হবে এবং গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি তাতে স্বাক্ষর করবেন। মালামালগুলো থানা হেফাজতে থাকবে এবং হেফাজত মুক্ত হওয়ার পরে সেগুলো ফেরত পাবেন।’ 


আইন অনুযায়ী গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে ২৪ ঘণ্টার বেশি থানা হেফাজতে রাখা যাবে না উল্লেখ করে মশিউর রহমান আরও বলেন, ‘পুলিশ হেফাজতে থাকাকালীন যদি গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি তাঁর গ্রেপ্তারের বিষয়টি পরিবারকে জানাতে না পারেন, তাহলে আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে বিষয়টি জানাবেন।’ 


 ‘গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে কারাগারে নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি গ্রেপ্তারের বিষয়টি পরিবারকে জানাতে না পারলে কারাগারে অবস্থান করার সময় পরিবারের সঙ্গে মোবাইল ফোনে সপ্তাহে একদিন যোগাযোগ করতে পারবেন। তখন তিনি বিষয়টি পরিবারের লোকজন বা স্বজনদের কাছে জানাবেন। এরপর তিনি অপরাধের ধরনের ওপর ভিত্তি করে আদালতের মাধ্যমে জামিন পেতে পারেন।’ 


যদি পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে এবং আদালত যদি তাঁকে জামিন দেন তাহলে তাঁর মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পর্কে ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী আবদুল কাদের জিলানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘যদি পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করে আদালতে হাজির করে এবং আদালত যদি তাঁকে জামিন দেন তাহলে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিকে আর কারাগারে নেওয়া হবে না। তাতে আদালতের হাজতখানা থেকেই ছেড়ে দেওয়া হয়।’





Comments

Popular posts from this blog

রিমান্ড কি? রিমান্ডে কখন ও কেনো নেওয়া হয়? আদালতের নির্দেশনা কি?